পার্বত্য চট্টগ্রামে ছয় মাসে ১০৩টি মানবধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে

Published: 01 Jul 2025   Tuesday   

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০৩টি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩১৫ জন জুম্ম লোকজনের মানবাধিকার লংঘন, ৪৯ জনকে গ্রেফতার,৩০ জন ম্রো শিশু ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত ও ৩০০ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে। এছাড়াও জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ১৫টি ধর্ষণ,হত্যার সহিংসতা ঘটনা এবং ১৬ জন নারী মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির দীর্ঘ ২৭ বছরেও কোনো মৌলিক বিষয়সহ চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা বাস্তবায়ন না হওয়ায় সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার পাঠানো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ ২৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তির কোনো মৌলিক বিষয়সহ চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমান সরকারও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ পুনর্গঠন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন করলেও বাস্তবে চুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাসমূহ বাস্তবায়নে সরকারের তরফে আন্তরিক কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। গত ১২ জানুয়ারি ২০২৫ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠনের পর প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও উক্ত কমিটির কোন বৈঠক এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিকায়ণের মাধ্যমে ফ্যাসীবাদী কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের নীতি অব্যাহত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বানচাল, সর্বোপরি জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের উদ্দেশ্যে শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, সেটেলার, সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, ভূমিদস্যু বহিরাগত বিভিন্ন কোম্পানী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি সকল পথ ও অপশক্তিকে ব্যবহার করে চলেছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের গত ছয় মাসে ১০৩টি ঘটনার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৪৮টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১২৫ জন লোক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে ও ৩৪টি গ্রামে টহল অভিযান চালানো হয়। তার মধ্যে ১৯ জনকে সাময়িক আটকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৯ জনকে, মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে ৯ জন। রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষ কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, উত্যক্তকরণ, প্রতারণার ১৫টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং ১৬ জন নারী মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের দ্বারা অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মারধর, হত্যা, গুলিতে আহত, তল্লাসী, হত্যার হুমকি, টাকা ও মোবাইল ছিনতাই, চাঁদা দাবির ১৯টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩জনকে হত্যাসহ ৯৫ জন ব্যক্তি ও ৫টি গ্রামের অধিবাসীদের মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে। মানবধিকার লংঘনের মধ্যে রয়েছে গত ১৫ মে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক লালতেøং কিম বম (৩০) নামে এক বম হাজতি চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন এবং সংময় বম (৫৫) নামে আরও এক বম গুরুতর অসুস্থ হলে জামিন পাওয়ার একদিন পর ১ জুন মারা যান।
গত ১৯ জানুয়ারি নবপ্রতিষ্ঠিত পৌয়ামুহুরীতে সপ্তশীষ মডেল একাডেমি মসজিদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার নামে কোমল শিশু শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামী কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। কক্সবাজারের ইদগাঁও এলাকার ইক্বরা তাহসীনুল কুরআন মাদ্রাসায় ৩০জন ম্রো শিশুরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে শিক্ষার কথা বলে মৌলবাদী ও ধর্মব্যবসায়ী একটি চক্র বান্দরবানের আলিকদম, থানচি, লামাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে গিয়ে এসব ম্রো শিশুদের ধর্মান্তরিত করে প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে দাবী করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ মে বান্দরবানের থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নে চিংমা খিয়াং (২৯) নামে খিয়াং নারী গণধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন। উক্ত ঘটনায় তদন্ত করা তো দূর অস্ত, হত্যার সুরতহাল রিপোর্টও এখনো পর্যন্ত ভুক্তভোগী স্বামীকে প্রদান করা হয়নি। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম নারী ও শিশুদের উপর চলমান সহিংস ঘটনাবলীর ন্যায় বিচার পাওয়া যায়নি এবং ঘটনার সাথে জড়িতদেরকে রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্যোগে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। ফলে জুম্ম নারীর উপর যৌন সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সুবিধাবাদী, দালাল ও উচ্ছৃঙ্খল কিছু লোককে নিয়ে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করে চলেছে। এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইউপিডিএফ (প্রসিত), মগপার্টি, বমপাটি খ্যাত কেএনএফ ইত্যাদি। অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলেও জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপদের লেলিয়ে দিয়ে চলেছে।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমেক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে একপ্রকার দেউলিয়া হলেও সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, চুক্তির পক্ষের নিরীহ লোকজনকে হত্যা, সাধারণ গ্রামবাসীকে মারধর, হয়রানিসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম জোরদার করেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিডিএফ কর্তৃক জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বানোয়াট অপপ্রচার, হত্যা, অপহরণ বাণিজ্য ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউপিডিএফের অপহরণ বাণিজ্যের মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা হচ্ছে। গত ১৬ এপ্রিল ২০২৫ খাগড়াছড়ির গিরিফুল এলাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে অপহরণ। এই অপহরণের ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠে। অপহরণের পর ইউপিডিএফ অপহৃত শিক্ষার্থীদের এক সপ্তাহ ধরে আটকে রাখে। তাদেরকে শারিরীক ও মানসিক হয়রানি ও হুমকি প্রদান করে। পরে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অপহৃতদের মুক্তি দেয়। গত ৮ জানুয়ারি ইউপিডিএফ পানছড়ির ধুদুকছড়া থেকে নয়নজ্যোতি চাকমা ও সাগর চাকমা অপহরণ করে। তাদেরকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মুক্তি প্রদান করা হয়।
ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে পানছড়িতে রূপসী চাকমা (২৬) নামে এক নারী নিহত হন এবং বাঘাইছড়ির বঙলতলীতে একজন শিশু আহত হয়। এছাড়া ১২ মার্চ সুবলঙে ইউপিডিএফ (প্রসিত) সন্ত্রাসীদের গুলিতে কমল বিকাশ চাকমা (৪৯) নামে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা জনসংহতি সমিতির এক সদস্য নিহত এবং অপর একজন গ্রামবাসী আহত হন।
এছাড়া গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় প্রকাশ্যে ‘ষ্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’র ব্যানারে সেটেলার ও মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র উপর নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়। এ হামলায় কমপক্ষে ১৮ জন আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী ও যুবক গুরুতরভাবে আহত হন। পূর্বের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর মতো উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোতে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হলেও পরে তিন জনকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। উক্ত ঘটনার যথাযথ বিচার এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।
--প্রেস বিজ্ঞপ্তি।

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত