পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ উষাতন তালুকদার বলেছেন, বেইলী রোডে কমপ্লেক্স করে দেওয়া আর পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এক নয়। সরকার জাতিসংঘে গিয়ে পার্বত্য চুক্তি নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। পাহাড়ের জনগণ শেখ হাসিনার উপর আস্থা রেখে তৃতীয় পক্ষ ছাড়া চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এখন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে। আপনাদের কাঁধে যে জাত্যভিমান ভর করেছে তা নামিয়ে ফেলুন। বড় জাতি হিসেবে আপনাদের মনের অধিকারী হতে হবে কারণ আপনারাও নিপীড়িত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, আতংক, ভয় থেকে মুক্তি দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করুন।
সোমাবার রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের(পিসিপি) ৩৫ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ২৮ তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উপলক্ষে আয়োজিত ছাত্র ও যুব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে মৃত আইন ঘোষণার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে দাবী করে বলেন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিটি বিভিন্ন আইনজীবি সহায়তা নিয়ে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ পার্টির নেতারা আগামী ২৩ জুলাই পর্ষন্ত উচ্চতর আদালত স্থগিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তা না হলে এই আইনটি বাতিল বা রহিত করার সম্ভাবনা ছিল। তিনি উপস্থিত সমাবেশের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের জ্ঞান, মেধা, বিদ্যা ছাড়া এই অসম লড়াইয়ে জয়যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের ছাত্র বন্ধুদের আরো অধিকতর জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ করতে হবে। জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে আমাদেরকে লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। সময়কে গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ও গণমুখী শিক্ষা লাভ করে আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে আমাদের লড়াইয়ের জন্য, নেতৃত্ব বিকাশের জন্য।
রাঙামাটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গনে আয়োজিত ছাত্র ও যুব সমাবেশে সমাবেশে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে অন্যান্যর মধ্য বক্তব্য দেন শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি দীপক শীল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ই, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি শান্তি দেবী তংচংগ্যা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিয় তংচংগ্যা।
সমাবেশ শেষে একটি র্যালী বের করা হয়। র্যালীটি জিমনেসিয়াম চত্বর শুরু থেকে করে বনরুপা পেট্রোল পাম্প পর্ষন্ত ঘুরে আবারও জিমনেসিয়াম চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। এর আগে জাতীয় পতাকা ও বেলুন উড়িয়ে উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য মাধবীলতা চাকমা। মঙ্গলবার রাঙামাটি সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট মিলনায়তনে প্রতিনিধি সন্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে।
সমাবেশে পিসিপির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা অভিযোগ করে বলেন, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রণ্টের সন্ত্রাসীদের দমনের নামের বান্দরবানে বম সম্প্রদায়ের লোকজনদের ও্পর নির্যাতন ও হত্যা করা হচ্ছে। সন্ত্রাসী দমন নামে সাধারন মানুষকে হয়রানী,অত্যাচার ও জলুম বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তিনি জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থি, চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম ধ্বংসের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকুরীতে আদিবাসীদের জন্য শতকরা ৫শতাংশ কোটা পুনর্বহাল, বান্দরবানে সাধারণ বম নাগরিকরাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত,দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আদিবাসীদের উৎসবের দিনে ছুটি নিশ্চিত করাসহ সাত দফা দাবি জানান।
মাধবীলতা চাকমা বলেন, এম এন লারমার দেখানো পথে আমদের এগোতে হবে। পাহাড়ের যুগপৎ আন্দোলনে যুব সমাজের কোনো বিকল্প নেই। চুক্তি করলেও আমদের কাজ শেষ হয়নি । চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ে আজো শান্তি ফিরেনি। আত্মমুখহীনতা সুবিধাবাদ ও দোদুল্যমানতা পরিহার করে ছাত্র যুব সমাজকে এগিয়ে যেতে হবে।
শিশির চাকমা বলেন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ লড়াইয়ের ৩৫ বছর প্রমাণ করে তারা জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের ব্যানগার্ড। সামনের রাজপথ সমৃণ নয়, যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা করা হচ্ছে সেই সকল বাধাকে প্রতিহত করে ছাত্র সমাজকে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত থাকলে বাংলাদেশ শান্ত থাকতে পারে না। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, আদিবাসী মানুষ সাধারণভাবে বাঁচতে চাই তাদের সমুন্নত মান সম্মান নিয়ে।
সমাবেশে মুক্তা বাড়ৈই বলেন, ২০২১ সালের শিক্ষা আইন একটি কারিগর মিস্ত্রী তৈরি করার কারখানা। অন্য ক্ষেত্রে বাজেট বাজলেও শিক্ষার কোনো বাজেট বাড়েনা। প্রাথমিক শিক্ষা একটি মানুষের মৌলিক অধিকার কিন্তু ২২০০০ গ্রামে এখনো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।এখনো অনেক এলাকায় মাতৃভাষায় শিক্ষা দান দিতে আজকের সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার বার বার পাবর্ত্য চুক্তি বাস্তবায়নে টালবাহানা করছে। সেক্যুলার বিজ্ঞান সস্মত শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ণসহ পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের জোর দাবী জানান তিনি।
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা বঞ্চনার কথা শোনাতে চাই না আর প্রতিবাদের কথা শোনাতে চাই। মরার পরেও বেঁচে থাকতে চাই নাকি বেচে থেকেও মরতে চাই তা আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে। আজ আমাদের পায়ের তলায় মাটি নেই, ১৯০০ সালের ঐতিহাসিক শাসনবিধি দলিলকে বাতিলের জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। জুম্ম জনগণের স্বপ্নের সনদ পার্বত্য চুক্তিকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। শাসকগোষ্ঠীকে জানান দিতে চাই, জুম্ম জনগণ যুদ্ধ চাই না শান্তি চাই, সরকার যদি যুদ্ধের বায়না ধরে জুম্ম জনগণ বসে থাকবে না।
দীপক শীল বলেন, পাহাড় কি বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হওয়ার পরও পাহাড় সেনাবাহিনীর দ্বারা শাসিত হবে। পার্বত্য চুক্তিকে বাস্তবায়নের নামে একটি নাটক সাজিয়ে রাখা হয়েছে না হলে ২৬ বছর পেরিয়ে যেতো না পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের। বর্তমান সরকার কথিত গণতন্ত্রের নামে একটি ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছে। সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হবে যেখানে সকল জাতিসম‚হের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সুমিত্র চাকমা বলেন, পাহাড়ে যখন একের পর এক গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছিলো তখন লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৮৯ সালের ২০ এ মে ঢাকার রাজপথ কাপিয়ে পিসিপির জন্ম হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পিসিপি আপোষহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পিসিপি প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে পাহাড়ের যে কোনো আন্দোলন এ পিসিপি ছিলো সর্বদা প্রাগ্রসর। পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরেও এসে সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়ন না করে উল্টো উন্নয়নের নামে পাহাড়ীদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। অধিকার কেউ কাউকে দেয়না, লড়াই করে ছিনিয়ে আনতে হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.