পাহাড়ে মানুষের স্বাতন্ত্র্য,ভূমির অধিকারের রক্ষাকবচ ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’(পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০)। হাই কোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ মৃত আইনে রায় দিলেও রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপীল করায় সিএইচটি রেগুলেশনটি জীবিত আইন হিসেবে রায় পায়। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ চেয়ে রেগুলেশনে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শব্দ,বাক্য,অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে হলফনামা আকারে সুপ্রীম কোর্টে দাখিল করা হয়েছে। এতে পাহাড়ের সুশীল সমাজ এ আইনের সুরক্ষা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। এতে বলা হয় আইনের অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ভাবাবেগকে গভীরভাবে আঘাত করবে। পাশাপশি পাহাড়ে অসন্তুষ্টি, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা তৈরি ও শান্তি প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত হবে।
জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে পাহাড়ে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীদের স্বাতন্দ্র্য ভূমি,প্রথাগত বিচার ও অধিকারের লক্ষে `‘সিএইচটি রেগুলেশনটি বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ১৯০০ সালের ১ মে থেকে এ শাসনবিধি কার্যকর হয়। এ রেগুলেশনটি বিচার, ভূমি, রাজস্ব ছাড়াও প্রথাগত রাজা (চীফ) হেডম্যান এবং পুরানো প্রথাগতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া ১৯৯৭ সালের ২ ডিসম্বর পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন-১৯৯৮ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯, পার্বত্য জেলায় জজ কোর্টের কার্যক্রমেও এ রেগুলেশন অনুসরন করা হয়। তবে ২০০৩ সালে রাঙামাটি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড এর দায়ের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০’- কে `মৃত আইন` বলে রায় দেন।
তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার সুপ্রীমকোর্টের আপিল করলে সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগ ১৯০০ রেগুলেশনের বৈধতা বজায় রেখে ‘সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০ এ সম্পূর্ণ “জীবিত ও বৈধ আইন” ঘোষনা দেন। এছাড়া সিএইচটি রেগুলেশন মর্যাদাকে স্বীকৃত রেখে ওয়া¹াছড়া টি এস্টেট লিমিটেড এর অপর একটি মামলায় অপিল বিভাগেও একই রায় দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ির দুই বাসিন্দা মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল রিভিউটি হলফনামা আকারে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আবেদন করেন। এ আবেদন উপর আগামী ১৯ অক্টোবর শুনানী দিন ধার্য্য করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, সুপ্রীমকোর্টে দুটি রায়ের সাথে সামজ্ঞস্য রেখে রীতি অনুসারে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের অবস্থানের কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে থাকা রাজা ও প্রথাগত আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত সর্বমোট দশটিরও অধিক অনুচ্ছেদ ও শব্দ বাদ দেওয়ার প্রার্থনা করেন । তবে “রাজা” শব্দটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্বীকৃত রয়েছে। রিভিউ আবেদনটি গৃহিত হলে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুসংস্কৃতির গঠন বিন্যাস ও এই অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্টকে দুর্বল করে ফেলবে। এছাড়া পার্বত্য চুক্তিতে “অনগ্রসর উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা” পার্বত্য জেলা পরিষদ ১৯৮৯ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ১৯৯৮- এর আইনের উপর সরাসরি আঘাত পড়বে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, রেগুলেশনের উপর হাত দেওয়া মানে হচ্ছে আমাদের অস্থিত্বের উপর হাত দেওয়া সামিল। একটি অংশ আমাদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে চায় তার প্রমাণ এটি। নিষ্পত্তি হওয়া একটি রায়ের উপর রিভিউর জন্য সুপ্রীম কোর্টে কার্য তালিকায় রাখা হচ্ছে তাও আবার এ সরকারের আমলে। সরকার বা বর্তমান প্রধান বিচারপতির পরিবর্তন ঘটলে এ রায়কে অকার্যকরের ষড়যন্ত্র করা হবে যা সন্দেহের বাইরে নয়।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, সিএইচটি রেগুলেশন যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করে আসছে পাহাড়িরা। এ রেগুলেশনের সাথে সংগতি রেখে পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তিকে রাজা, হেডম্যান, কার্বারীসহ ইত্যাদি স্বীকৃত। এখন এসব শব্দসহ গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো বাতিল করা হলে রেগুলেশনটি না থাকার সমান হবে।
চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, সিএইচটি রেগুলেশনকে মৃত আইন রায় দেওয়োর পর এ রায়ের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার আপীলে জীবিত আইন হিসেবে রায় পায়। যেহেতু এটর্নী জেনারেল সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা সেহেতু এ রায়ের বিরুদ্ধে যারা রিভিউ চেয়েছেন তাদের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান থাকার কথা। কিন্তু তিনি তা না করে রিভিউকে সমর্থন জানিয়ে রায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে হলফনামা আকারে সুপ্রীম কোর্টে দাখিল করেছেন। এটা এক প্রকার সরকারের পক্ষের রায়ের বিরোধীতা করার মত।
তাছাড়া পার্বত্য মন্ত্রনালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ তো সরকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান সিএইচটি রেগুলেশন অনুসরণ করে। সেহেতু এটর্নী জেনারেলের উচিত ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করা। কিন্তু তিনি তা না করে রেগুলেশনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ বাদ না দিতে সুপ্রীম কোর্টে প্রার্থনা করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং বলেন, এ সিএইচটি রেগুলেশনের উপর নির্ভর পার্বত্য চুক্তি। এটি পরিবর্তন করতে হলে স্থানীয় মানুষের সাথে আলাপ-আলোচনায় বসতে হবে। এ বিষয়টি তার কাছে আসার পর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক আবুল হাসানত আব্দুল্লাহের সাথে কথা বলেছেন। এছাড়া আইনমন্ত্রীকে অবহিত করা ছাড়াও বিষয়টি নিয়ে এটর্নী জেনারেলের সাথেও কথা বলেছেন। পাশাপশি তিন পার্বত্য জেলার এমপি, সংরক্ষিত মহিলা এমপির সাথেও কথা বলেছি।
---হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.