ছয় মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১৩টি মানবধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে

Published: 01 Jul 2023   Saturday   

চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুন পর্ষন্ত গত ছয় মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১৩টি মানবধিকার লংঘনের ঘটনায় এক হাজার ৩৯২ জন পাহাড়ী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ও শিশুর উপর ১২টি সহিংস ঘটনা ও ১১ জন নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। তাদের একজনকে হত্যা, ৬ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা এবং ২ জন নারী ও শিশুকে অপহরণ ও পাচারের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে।


শনিবার সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির(পিসিজেএএস) কেন্দ্রীয় সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার পাঠানো চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুন পর্ষন্ত অর্ধ-বার্ষিক পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।


প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিগত ছয় মাসে ১১ জন পাহাড়ী জুম্ম নারী ও শিশু হত্যা, অপহরণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হলেও ১২টি ঘটনার মধ্যে মাত্র ২টি ঘটনার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি ১০টি ঘটনার কমপক্ষে ২৪ জন অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। নারী ও শিশুর ওপর যত সহিংসতার ঘটনায় বিচারহীনতার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। ফলে জুম্ম নারীরা আজ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ৮০টি বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার ৩০ পরিবারের ফসলি জমি নষ্ট করা হয়েছে। এছাড়া ১১৩টি ঘটনার মধ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের দ্বারা ২৯টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ১ হাজার ৩০ জন ও ২৩টি গ্রামের অধিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে হত্যা, ৬ জনকে মারধর, ১১ জনকে অপহরণ, ২২ জনকে আটক, ২ জনকে আটক করার পর পুলিশের কাছে সোপর্দ, ১৯৫ বম ও মারমা পরিবারের প্রায় এক হাজার গ্রামবাসীদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ এবং ১৭টি গ্রামের অধিবাসীদের নানা ধরনের হয়রানি ও উচ্ছেদের হুমকির ঘটনা ঘটেছে।


প্রতিবেদনে দাবী করা হয়, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, পুর্নবাসিত বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক ১২টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ১৮টি পরিবার ও ১৩০ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ২ জনকে হত্যা, একজনকে মারধর, ২ জন জুম্ম গ্রামবাসীর ভূমি জবরদখল এবং ১৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আইন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৬০টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ৩১১ জন মানবাধিকার শিকার হয়েছে।


প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে দাবী করে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দীর্ঘ ২৫ বছরেও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষমতাসীন সরকার সাড়ে ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও সরকার ২০১৪ সাল থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ রাখায়, একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়নের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর ও বিস্ফোরন্মুখ হয়ে উঠেছে।

 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মসহ স্থায়ী অধিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণসকল অস্থায়ী সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসনের অবসানভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব ভূমিতে পুনর্বাসনস্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানবিশেষ শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার সাধারণ প্রশাসনআইন-শৃঙ্খলা ও সকল উন্নয়ন সমন্বয়তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করার কথা থাকলেও সেখানে এর কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। 

 

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সম্প্রতি ১৭-২৮ এপ্রিল ২০২৩নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সদরদপ্তরে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামের ২২তম অধিবেশনে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব  হামিদা বেগম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে” বলে জাতিসংঘের মতো বিশ্ব ফোরামে অসত্য তথ্য তুলে ধরেছিলেন। অথচ চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছেযা বিভিন্ন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গবেষক ও প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফলাফলেও উঠে এসেছে। ফলে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহসহ এখনো চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা হয় আংশিক বাস্তবায়িত নয়তো সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও জনসংহতি সমিতি এই ব্যবধান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির মাধ্যমে নিরসন করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যেজাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামের উক্ত অধিবেশনের গৃহীত রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য অধিকতর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যেপার্মানেন্ট ফোরামের উক্ত আহ্বানে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার এখনো কোনো সাড়া প্রদান করেনি। অথচ জাতিসংঘের এধরনের আহ্বানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা সরকারের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

 

প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ  কুয়াকাটায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৭ম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পূর্ববর্তী সভাগুলির মতো ৭ম সভায় দেখা গেছেচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তবলী বাস্তবায়নের কোন অগ্রগতি নেই। ফলে সরকারের অসহযোগিতা ও গড়িমসির কারণে বর্তমানে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটিও অথর্ব সংস্থায় পরিণত হয়েছে। 

--প্রেস বিজ্ঞপ্তি। 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত