মাতামুহুরী নদীর বুকে জেগে বসেছে ধুধু বালুর চর

Published: 18 Apr 2015   Saturday   
no

no

দক্ষিন-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিমে ভূমিঢাল বিশিষ্ট এককালের প্রমত্তা মাতামুহুরী নদী আজ প্রচন্ড নাব্যতায় ভুগছে। যা দেখার মত কেউই নেই। পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দক্ষিন-পূর্ব সীমান্তে জন্ম নিয়ে আলীকদম, লামা ও চকরিয়া উপজেলার বুক চিরে বয়ে চলা উত্তর-পশ্চিম ভুমি ঢাল নিয়ে বয়ে গেছে কালের স্বাক্ষী এই মাতামুহুরী নদী। কালের আবর্তে আজ মরা নদীতে রূপ নিচ্ছে। বর্ষা শেষ হতে না হতেই এ নদীর বুকে নৌ চলাচল, কাঠ ও বাঁশ পরিবহনে দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। এককালে জেলার লামা-আলীকদম উপজেলায় এই নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল জনবসতি। যাতায়াতে একমাত্র মাধ্যম ছিলে নৌকা। সুদিন-বর্ষা সব সময়ই এ নদীর বুকে নৌকা চলত অনায়াসে।

 

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মাতামুহুরী কালের বিবর্তনে শীর্ণকায় নদীতে রূপ নিয়েছে। এ নদীর উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত রয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি ঝিরি ও খাল। প্রকৃতির বুক চিরে বয়ে চলা এসব ঝিরি ও খালের মিলন স্থল মাতামুহুরীর নদীর কোন না কোন পয়েন্টে। আলীকদম সদর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দুরে পাহাড় ভাঙা মুরুং পাড়া থেকে ১০ মিনিট উজানের দিকে অগ্রসর হলেই এ নদীর উৎপত্তিস্থলে পৌঁছা যায়। ইংরেজী বর্ণ ওয়াই অক্ষরের মতো আকার নিয়ে এ মাতামুহুরী নদীর জন্ম হয়েছে। অনেকের মতে এখানেই মাতামুহুরী পরিসমাপ্তি। সমাপ্তিস্থল থেকে উত্তর দিক হতে দুছরী ও দক্ষিণ দিক হতে ফাত্থারা খালের জলরাশি মাতামুহুরী নদীতে মিশে একাকার হয়েছে। এ নদীর ভূমি ঢাল উত্তর-পশ্চিমমুখী। উৎপত্তিস্থলে থেকে সর্পিল গতিতে একেবেঁকে মাতামুহুরী নদী আলীকদম-লামা ও চকরিয়া উপজেলার বুক চিরে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

 

খরস্রোতা এ নদীর উৎপত্তি বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলা সদর থেকে প্রায় নব্বই কিলোমিটার দক্ষিন-পূর্বে মায়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ের পাদদেশে। এককালের প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর পানির প্রবাহ থাকলে  এখন দিন দিন কমে যাচ্ছে। নদীর দুদ্বারে ভেসে উঠছে ধুধু বালুর চর। হুমকির মুখে পড়েছে মৎস্য সম্পদও। গ্রীষ্মের প্রকর তাপদাহে সামান্য পরিমানে পানি সহজেই উত্তপ্ত হয়ে যায়। যার কারণে এ নদী মাছের বসবাসের সম্পুর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এক সময় যেসব জেলে পরিবারের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন ছিল এই মাতামুহুরী নদীর মাছ আজ সেসব জেলে পরিবারের নেমে এসেছে চরম হতাশা।

 

পরিবেশবাদীদের মতে, এখন এ মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা পুনরুদ্ধার সময়ের দাবি। এ নদীর নাব্যতা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব শুধুমাত্র নদী ড্রেজিং এর মাধ্যমেই। যার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে শুধু মাত্র সরকারকেই। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে নাব্যতা সংকটে পড়ে চির যৌবনা এ মাতামুহুরী নদী হারিয়ে ফেলবে তার আসল পরিচয়।

 

জানাগেছে, আশির দশকে মাতামুহুরী নদীর গভীরতা ছিল ৫০ থেকে ৬০ ফুট। প্রস্থ ছিল ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ ফুট পর্যন্ত। এককালের মাতামুহুরী নদীর খুটি খ্যাত বড় বড় কুমগুলোও এখন আর নেই। এ নদীর উল্লেখযোগ্য কুমগুলোর মধ্যে রয়েছে ভুঝির কুম, মাছ কুম, চেলার কুম, মহল্লার কুম, দুঃখ্যা-শুখ্যার কুম, তৈন খালের কুম, গ্যাস কুম এছাড়াও আরো অসংখ্য কুম ছিল এ নদীতে। বর্তমানে এসব কুমগুলো শুধুমাত্র নামে মাত্রই রয়েছে।

 

সরেজমিনের সময় দেখা যায়, এসব কুমগুলো এখন ধুধু বালুর চর। অথচ এককালে গভীর জলরাশি সম্পন্ন প্রমত্তা মাতামুহুরী এখন শীর্ণকায় নদীতে রূপ নিয়েছে। সরকারী পরিসংখ্যান মতে, মাতামুহুরী নদীর আয়তন ছিল প্রায় ১৮শ ৮০ একর।

 

সূত্র মতে, মাতামুহুরী নদীর নামানুসারে গড়ে উঠেছে ১ লক্ষ প্রায় ৩ হাজার একরের বিশাল রিজার্ভ ফরেস্ট। এ রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে গত দেড় দশক ধরে অবাধে বৃক্ষ নিধন, বাঁশ কর্তন ও পাহাড়িয়া জুম চাষের কারণে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে পড়ছে নদীতে। ফলে নদীর তলদেশ ক্রমশঃ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পাহাড় ও ঝিরি খুঁড়ে অবাধে পাথর উত্তোলনের কারণে ঝিরি থেকে পানির প্রবাহ কমে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বংশ পরম্পরায় জুম চাষ করে আসছে। প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পাহাড় বা টিলা বেছে নিয়ে জুম চাষের কারণে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে নদীগুলোতে নেমে এসে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।  নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।

 

অন্যদিকে প্রতি বছর গ্রীষ্মে মাতামুহুরী নদীর দুদ্ধারে কয়েক হাজার ডিজেল মেশিন বসিয়ে এ নদীর সুবিধাভোগী লোকজন চাষ করে যাচ্ছে কয়েক লক্ষ একর তামাক। যার কারণে ইরি-বোরো ও রবি শস্যের চাষীরাও চরম দুর্ভোগে পড়ছে বলে দাবি করেছে পরিবেশবিদ ও স্থানীয় সচেতন মহলের। এককালে এখানকার কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য স্থাানীয় ভোক্তার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করতো। এতে করে চাষীরা মাতামুহুরী নদীর সুফল নিয়ে প্রতিবছর চাষাবাদের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুুত্বপুর্ণ অবদান রাখতো। কিন্তু বর্তমানে মাতামুহুরীর দুর্দিনের কারণে জাতীয় অর্থনীতির কথাতো দুরের কথা স্থানীয় খাদ্যপুষ্টির চাহিদা মেটানোও দুরহ হয়ে পড়েছে।

 

আলীকদম উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা নারী উন্নয়ন ফেরামের সভাপতি শিরিনা আক্তার বলেন, এক সময় এ মাতামুহুরী নদীই ছিল এসব এলাকার জনসাধারনের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু আজ তার উল্টোটাই প্রতিয়মান। এখানকার আদীবাসিরা এখনো জুম নির্ভরশীল। তাই জরুরীভিত্তিতে জুমের বিকল্প চিন্তা করা উচিৎ। অনেক মুরুং জনগোষ্ঠীর লোকজন জুমের বিকল্প বাগান করে আগের তুলনায় অনেক স্ব-নির্ভর হয়েছেন। সকল জুমিয়ারা যদি জুমের বিকল্প চিন্তা করেন তাহলে তারা সহজেই অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বিতা অর্জন করতে পারবেন। এতে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় রোধ কমানো যাবে এবং নদীর নাব্যতাও স্থীতিশীল অবস্থায় রাখা যাবে বলে তার ধারনা।

 

তিনি লামা-আলীকদম-চকরিয়াবাসীকে এ মাতামুহুরী নদীকে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে এ নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে যতদ্রুত সম্ভব  যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানান।

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত