কক্সবাজারের লাকিংমে চাকমার ঘটনা প্রবাহ সরেজমিন পর্যবেক্ষণ নিয়ে নাগরিক প্রতিনিধি দলের সংবাদ সম্মেলন

Published: 05 Jan 2021   Tuesday   

মঙ্গলবার ঢাকায় কক্সবাজারের টেকনাফের লাকিংমে চাকমার ঘটনা প্রবাহ সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর পর্যবেক্ষণ নিয়ে নাগরিক প্রতিনিধি দলের উদ্যোগে প্রতিবেদন উপস্থাপন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মূখপাত্র ধনঞ্জয় চাকমার পাঠানো এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সন্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল। প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, এমলআরডির রফিক আহম্মেদ সিরাজী ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যাবিলন চাকমা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রতিনিধি শাহনাজ সুমীর।

 

সংবাদ সন্মেলনে ৭ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হল বয়স প্রমাণের পর এটা নিশ্চিত হয়েছে যে লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছিল, এরপর কিশোরী মেয়েটি জোরপূর্বক ধর্মান্তর, বিয়ে, যা ধর্ষণের নামান্তর। তাই নিয়মিত মামলা দায়ের করে এক্ষুণি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার, অবশ্যই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা,  লাকিংমে আত্মহত্যা করেছে, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা নিশ্চিত  করতে হবে, লাকিংমে চাকমার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, লাকিংমের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ঘটনার প্রথম তদন্তের পিবিআই যে অবহেলা করেছে তার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে, সনদ জালিয়াত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটি মেয়ের জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বিয়েতে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং লাকিংমের সন্তান কোথায়, কার তত্ত্বাবধানে থাকবে তা মীমাংসা করতে হবে।

 

সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, এদেশে বহুজাতিস্বত্তা আছে। তারা অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। তাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা দরকার। লাকিংমে চাকমার মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রশাসন ও র‌্যাবের সহযোগিতার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরকরণ, অপহরণ, হত্যা ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

 

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, যখনই অন্য ধর্মের  মানুষকে বিয়েতে বসানো হয় তখনই ধর্মান্তকরণ ও  ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদান করে বয়স লুকিয়ে ফেলার প্রবণতা আমার দেখি যা আইনের চোখে বড় অপরাধ। লক্ষণীয় বিষয় সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে কারণ চারদিক থেকে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ তাদেরকে চারদিক  থেকে ঘিরে ফেলছে। তাদেরকে সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোন ব্যবস্থা নেই এবং মানবাধিকার সংগঠনগুল্ওো এ জায়গায় কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। লাকিংমে চাকমার ঘটনায় অপরাধীদেও আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করতে হবে।

 

শাহনাজ সুমি বলেন-সরেজমিন পরিদর্শন দলের পক্ষ থেকে ৫টি অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই  অপরাধসমূহের ভিত্তিতে অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের দাবি জানাই। অপরাধসমূহ হল,লাকিং মে চাকমাকে অপহরণ, ধর্মান্তকরনে বাধ্য করা, অপ্রাপ্ত বয়সীকে বিয়ে করা, ধর্ষণ ওআত্মহত্যায় প্ররোচনা করা। এই ৫টির যে কোন একটিই অভিযুক্তকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে যথেষ্ষ্ট।

 

ব্যাবিলন চাকমা বলেন, লাকিংমে চাকমার অপহরণ, ধর্মন্তকরণসহ জোরপূর্বক বিবাহ এবং হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আতিউল্লাহসহ তার সহযোগীদের সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আদিবাসী নারীদের উপর এধরনের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা এ ধরনের কাজ করার সুযোগ পায়।

 

ফারহা তানজীম তিতিল প্রতিবেদন উপস্থাপনে বলেন, গেল বছরের ৫ জানুয়ারি অপহৃত হয় লাকিংমে চাকমা। জন্মসনদ অনুযায়ী, অপহৃত হওয়ার দিনটিতে ওর বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। আমাদের অনুসন্ধানে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, অপহরণের পর ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত লাকিংমেকে আশপাশের  গ্রামে রাখা হয়। ৯ জানুয়ারি ওকে নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফেরই শাহপরীর দ্বীপে। সেখানে জনৈক কালা মনুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল অন্তত দুদিন। টেকনাফ থানা ন্যূনতম উদ্যোগ নিলে আত্মজাকে উদ্ধার করতে পারতেন লালা অং। ১১ জানুয়ারি আতাউল্লাহ ওকে নিয়ে যায় কুমিল্লায়। এরপর কুমিল্লার আদালতে লাকিংমেকে ধর্মান্তর এবং একটি কাজি অফিসে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। টেকনাফেরই বাহারছড়া মাথাভাঙ্গা এলাকার ইয়াসিন, ইসা, আবুইয়াসহ আরও পাঁচজন লাকিংমেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। লালাঅং তাঁর মেয়ে অপহরণের পর মামলা করতে গিয়েছিলেন টেকনাফ থানায়। তখন কক্সবাজারের টেকনাফ থানাটিতে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বরখাস্ত এবং বর্তমানে জেলবন্দি প্রদীপ কুমার দাশ। থানায় মামলা করতে না পেরে ২৭ জানুয়ারি লালা অং কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তের নামে যে অবহেলা তারা করেছেন তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ক্যশৈনু মারমার দেওয়া দু পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন। অপহরণের পর কেটে যায় ১১ মাস। এ সময় মেয়েকে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন বাবা। অবশেষে গেল ৯ ডিসেম্বর লালাঅং তাঁর মেয়ে লাকিংমের খোঁজ পান। তবে জীবিত নয়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে তাঁর প্রিয় কন্যার মরদেহ।

 

তিনি আরো বলেন, ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমরা শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও আদিবাসী নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল গেল ২৮ ডিসেম্বর গিয়েছিলাম শিলখালি গ্রামে। আমরা সেদিন লাকিংমের বাড়ি, বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ অফিস এবং আতাউল্লাহর বাড়িতে যাই। ওই দিনই বিকেলে আমরা দেখা করি কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবং পাবলিক প্রসিকিউটরের সঙ্গে। এর পরের দিন ২৯ ডিসেম্বর কক্সবাজারে  র‌্যাব কমান্ডারসহ এই মামলার ভূমিকা রাখতে পারেন-এমন আরো ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও কথা বলেছি।

 

উল্লেখ্য গেল ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ঢাকা থেকে একটি নাগরিক সমাজের দল টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করেন। নাগরিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন কুষ্টিয়ারর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল, সমকালের জেষ্ঠ্য সাংবাদিক রাজিব নূর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার সম্পাদকদীপায়ন খীসা, নিউ এজের সাংবাদিক ইমরান নূর, ব্লাস্ট এর প্রতিনিধি তৌফিক-ই-ইসলাম, এএলআরডির প্রতিনিধি রফিক আহমেদ সিরাজী, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যাবিলন চাকমা প্রমুখ।

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

 

 

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত