২৩ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। অথচ দেশের স্বার্থে চুক্তি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। রোডম্যাপ ঘোষণাপূর্বক অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক স্রোতধারায় থাকতে হবে। বাঙালী ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা ও সমুন্নত করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩ তম বর্ষপূর্তী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মূখপাত্র ধনঞ্জয় চাকমার স্বাক্ষরিত এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আয়োজনে ঢাকার ধানমন্ডির উইমেনস ভলান্টারী এসোসিয়েশনে (ডভ্লিউভিএ)সভার আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজীম তিতিল প্রমুখ। এছাড়াও অনলাইনে যুক্ত থাকেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন ও সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা।
স্বাগত বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, এটা দুঃখজনক যে, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হতে পারেনি। আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি মোতাবেক মূল মূল বিষয় যেমন ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় পুলিশ, পর্যটন ইত্যাদি জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। চুক্তির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, ছয়টি ক্যান্টনমেন্ট ব্যতীত অস্থায়ী সেনাক্যাম্পগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ছড়িয়ে নেওয়া হবে। দুঃখের সাথে বলতে হয়, ক্যাম্প তো ছড়ানোই হয়নি বরং ইদানিং নিরাপত্তা ও সংঘাতের অজুহাত দিয়ে নতুন করে নতুন নতুন ক্যাম্প বসানো হচ্ছে। চুক্তি মোতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে আজ ২৩ বছরেও জেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচন দিতে পারেনি। সরকার যে দৃঢ়তা নিয়ে চুক্তি করেছিল সেই দৃঢ়তা নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করি।
রাশেদ খান মেনন অনলাইনে সংহতি জানিয়ে বলেন, পার্বত্য চুক্তি বর্ষপূর্তী একটি আনন্দের দিন ছিল, এখন আনন্দ করার বাস্তবতা আছে কি না আমি জানি না। পাহাড়কে এখন সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে কিনা? সামরিক সমাধানের মাধ্যমে নয় রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মাধ্যমে সমাধান খুজতে হবে। এরশাদের সময়কালে ও স্বশাসনের জন্য তিন জেলায় তিনটি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গঠন করা হয়েছিল। এখন পার্বত্য চুক্তি ইস্যুকে নিয়ে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এখন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নানা বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। চিম্বুকে ম্রো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে পাঁচতারা হোটেল নির্মান প্রচেষ্টা আমার বোধগম্য নয়। পর্যটন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নয়। সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভূমি সমস্যার সমাধান করা অতীব জরুরী। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। এ বাস্তবতাও চুক্তি বাস্তবায়নে প্রভাবিত করছে। পাহাড়ে যদি অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় তাহলে সেখানে পর্যটন হোক বা যে কোন ধরণের উন্নয়ন হোক কোন কিছুই টেকসই হবে না।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্যন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক একটি ভূমি বিরোধ বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হলেও যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত রীতি ও পদ্ধতি অনুসারে পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান মোতাবেক গেল ২৩ বছরে একটি বিরোধও নিষ্পত্তি হয়নি। চুক্তি নিয়ে সময়ক্ষেপন ও তালবাহানা করা হচ্ছে। কার্যত ভূমি কমিশনকে অকার্যকর করে রেখেছে সরকার।
তিনি আরও বলেন, ২৩ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত থাকার পাশাপাশি বিশেষভাবে সাম্প্রতিক সময়ে জুম্মদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘঁটনা বেড়ে যাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আবারও নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ফলে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী হতাশ ও বিক্ষুব্দ, দেশের নাগরিক হতাশ ও উদ্বিগ্ন। কার্যত পাহাড় আজ অশান্ত ও অবরুদ্ধ।
সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা অনলাইনে বলেন, আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। কিন্তু সেটা হতে পারছে না। রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যেও আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাব দেখতে পাচ্ছি । এটা দুঃখজনক। রাজনৈতিক সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। আমলারাই এখন দেশ চালাচ্ছে। ভোট এখন রাতের বেলায় হয়ে যায়। দেশ এখন অন্যরকমভাবে চলছে। এ বাস্তবতায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে।
কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজীম তিতিল বলেন, সত্য আসলে আড়াল করে রাখা যায় না। বাংলাদেশে গণ মানুষের আকাঙ্খা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এ অভিযোগটা সত্যি যে, পাহাড় থেকে সেনাক্যাম্পগুলো ছড়ানো হয়নি বরং সেনাশাসন জোরদার করা হয়েছে। পাহাড় কেটে কেন পর্যটন হবে? আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে কেন পর্যটন করা হবে? এ বিষয়গুলোর সুরাহা হতে হবে। অন্যথায় সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, উন্নয়ের নামে বৈষম্য চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চুক্তি করে চুক্তি না মানা খুব দুঃখজনক। আমরা একটা অলৌকিক বোধের মধ্যে চলছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটা কাল্পনিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চুক্তি নিয়ে আজকের পত্রিকাগুলোর খবরগুলো দেখলে বুঝা যায়। এভাবেই পার্বত্য পরিস্থিতিকে উপস্থাপিত করা হচ্ছে এবং চুক্তি নিয়ে তালবাহানা করা হচ্ছে। কিন্তু চুক্তি কার্যকর ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সাংবাদিক সোহরাব হোসেন বলেন, রাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চুক্তি করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করা হয়েছিল তেমনি বাস্তবায়ন করতেও বাধ্য করতে হবে। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি কর্তৃত্ববাদেও একটি প্রতিযোগীতা। ম্রোদের উচ্ছেদ করে রিসোর্ট করা হবে সেটা মানা যায় না। রাষ্ট্রের উচিত এগুলো বন্ধ করা। সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা হওয়াটা জরুরী।
অধ্যাপক মেসবাহ কামাল অনলাইনে বলেন, বহুজাতির দেশ বাংলাদেশ। এটাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। সবাইকে সাংবিধানিকভাবে বাঙালী করা হয়েছে। অন্য জাতিগোষ্ঠীরা উপেক্ষিত হচ্ছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোতে কোন সময়েই হাত দেওয়া হয়নি। বাস্তবায়ন অনেক দূরে। ভারত থেকে প্রত্যাগত অনেক জুম্ম শরনার্থী এখনো পুনর্বাসিত হতে পারেনি। সেটেলার বাঙালীরা তাদের জায়গা-জমিগুলো দখল করে রেখেছে। এর সমাধান রাষ্ট্রকে অবশ্যই করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সরকার বলছে চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ীরা বলছে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি। আমার মনে হয় এখানে একটা গ্যাপ রয়েছে। এ গ্যাপ পরিপূরণে আবার নতুন করে সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে। ২৩ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। যে অপেক্ষা করে সে জানে সময়টা কত দীর্ঘ। কোন নাগরিক যদি কষ্টে বা সংকটে থাকে সেটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আগামী ২ দুই বছরে চুক্তি পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হোক সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.