গোটা পৃথিবীই বলা চলে ঘোরতর বিপদে। মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের অদৃশ্য হানায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও সমূহ সংকটে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিশেবে বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্র যতোটা সক্ষমতা আছে, তার সবটা দিয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে।
রাজনৈতিক বোঝাপড়া, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অতীত অভিজ্ঞতা, দক্ষ জনবল, অপেক্ষাকৃত অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকলে বর্তমান বাস্তবতায় হয়তো আর একটু ভালো পারফর্ম করা যেতো। তারপরও দেশের বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি গবেষক, সরকারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জীবনবাজি রেখে যা করছেন, তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। যে পুলিশ সদস্যদেরকে আমরা কথায় কথায় নানা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করি, যে চিকিৎসকদের পেশা ও সেবা নিয়ে নানা সমালোচনা করি; আজকের করোনা অকালে তাঁরাই আমাদের সবচেয়ে নির্ভরতার ঠিকানা।
এখন পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ এবং চিকিৎসা সেবার সাথে সংশ্লিষ্টরাই। অনাকাঙ্খিত অকাল মৃত্যুর কাছে হেরে চলেছেন এখনো।
করোনার দুর্যোগের প্রথম থেকে কোন প্রকারের সুরক্ষা ছাড়াই নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এই জাতির জন্য যা করে চলেছেন; তার ঋণ জাতি শোধ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
একজন পেশাদার সংবাদকর্মী হিশেবে বাসায় যতোক্ষণ থাকি ততক্ষণই হয় টেলিভিশন নয় অনলাইনে দেশ-বিদেশের খবরের দিকেই আমার মনোযোগ থাকে বেশি। যখন একজন চিকিৎসক ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে কোন মানবিক প্রতিবেদন দেখি বা পড়ি, সত্যিই তখন চোখে জল এসে যায়। একজন সন্তান সম্ভবা নারী চিকিৎসক, একজন দুধের শিশুকে ঘরে রেখে দিনের পর দিন হাসপাতাল আর হোটেল কোয়ারেন্টিনে কাটিয়ে দেয়া জীবনের কথা কী ভাবা যায়?
আর এসব মানুষকে এই রোজার মাসেও অনেক নিষ্ঠুর বাড়িওয়ালা ও প্রতিবেশীর হাতে চরম নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে।
যখন দেখি করোনায় আক্রান্ত স্বজনকে নিজের সন্তানরাই ছুঁড়ে ফেলছেন, সৎক্রিয়া দূরে থাক, হাসপাতাল থেকে মরদেহ গ্রহণ করার মতো কেউ থাকে না; তখন তো সবার আগে ছুটে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাই।
ঝড়-বৃষ্টি-রোদ্দুর মাথায় নিয়ে রাতদিন খোলা আকাশের নিচে দায়িত্ব পালনকারী এসব মানুষ আমাদেরই কারো না কারো স্বজন। তাঁদেরও মা-বাবা-সন্তানসহ আমার. আপনার মতো পরিবার সমাজ আছে। রক্ত-মাংসের প্রাণি হিশেবে তাঁদেরও পারিবারিক-সামাজিক অনুভূতি আছে। শুধু কী একটি ডিউটি! নাহ. পুুলিশকে সামাল দিতে হচ্ছে অনেকটা ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ পর্যন্ত’।
দেশের সবচেয়ে পয়সাওয়ালা গরিব ‘গার্মেন্টস মালিক’-দের কারো কারো অমানবিক শ্রমিক শোষণের ফলে সৃষ্ট ক্ষতগুলোও উপশম করার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে সেই পুলিশকেই। এতোসব দায়-দায়িত্বের বাইরেও পুলিশ বাহিনী দেশে করোনাকালে ত্রাণ কার্যক্রমেও দেখিয়েছে অন্যরকম উদারতা।
জনপ্রতিনিধি-রাজনীতিক-শিল্পপতি আর কর্পোরেট হাউজের মালিকরা (সবাই নয়) যেখানে করোনাকালে করুণার এক অস্বস্তিকর ‘ফটোশেসন’-এ ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন. তখন পুলিশের বিশেষায়িতসহ সবকটি ইউনিট মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে নিরেট মানবিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই।
এদেশের বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি (বিশেষ করে মাননীয় সংসদ সদস্য) নিজ এলাকায় কখন আসছেন আর কখন যাচ্ছেন; সেটি সাধারণ জনগণ জানতেই পারছেন না। অনেকে এলাকায় থাকলেও জনগণের পাশে কতোটা আছেন. তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোতে।আর এসব কারণেই দেশে পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের অন্য এক ভালোবাসার নাম উচ্চারিত হচ্ছে ‘মানবিক পুলিশ’।
দেশের এই দুর্যোগে সরকার একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটি হলো পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হবার আগেই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী মাঠে নামিয়ে। যেকোন দেশেতো বটেই অধিকন্তু আমাদের দেশে যেকোন দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী সক্ষমতা ও দক্ষতা বর্হিবিশ্বেই স্বীকৃত। করোনাযুদ্ধে সেটি আরো একবার প্রমাণ হতে চলেছে। সারাদেশে মাঠে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজেদের অর্থায়নে সেনাবাহিনীর ব্যতিক্রমী ‘এক মিনিটের বাজার’ অভাবী মানুষের দারুণ আস্থা অর্জন করেছে।
আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক হোক আর সামরিক। সব শাসনামলেই জনগণের কাছে সবচেয়ে বেশি জবাবদিহিতার মুখোমুখে হতে হয় সিভিল প্রশাসনকে। এবারও কোনো জানি সরকার জনপ্রতিনিধির চেয়ে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপরই বেশি ভরসা রেখেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এখন পর্যন্ত সবকটি ভিডিও কনফারেন্সে তার প্রতিফলনই দেখতে পেয়েছেন দেশবাসী। এই উদ্যোগটিও সাধারণ মানুষ বেশ ভালোভাবেই নিয়েছেন। তবু দেশের অনেক জনপ্রতিনিধি (মাননীয় মন্ত্রী- সংসদ সদস্য -সিটি মেয়র-জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান-পৌর মেয়র এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান) নিজের এলাকার মানুষ-দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী সক্রিয় আছেন। যাঁরা সক্রিয় আছেন-ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন; তাঁদের প্রতি মানুষের শুভ কামনা বাড়বে বৈই কমবে না।
আমার নিজের পেশার কলম সৈনিকরা যাঁরা এরিমধ্যে অকালে পরপারে চলে গেলেন. তাঁদের আত্মার সদগতি কামনা করা ছাড়া তো আর কিছুই দিতে পারবো না। কিন্তু যাঁরা এখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সংবাদ ক্ষুধা, পাঠকের সংবাদ চাহিদা মেটাতে নিরন্তর পথ পাড়ি দিচ্ছেন... নিশ্চয়ই মানুষ তাঁদেরকেও মন থেকে শুভ কামনা জানাবেন।
সবশেষে একটি আবেদন, এই লেখার যাঁদের চোখে পড়বে তাঁদের প্রতি। আপনি যেই ধর্মের অনুসারী হোন নিশ্চয়ই সপ্তাহের-দিনের কোন না কোন সময় একটু হলেও পরম সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেন।
আর রাত পোহালেই তো পবিত্র ঈদের নামাজ। পবিত্র কোরান শরীফে রোজার মাসকে ‘রহমত-ফযিলতের মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই বাংলার কোটি কোটি মানুষ পুরো একটি সংযম সাধন করে কাটিয়েছেন। দেশের প্রতিটি মসজিদে কোটি কোটি হাত পাতা হবে পরম দয়ালের কাছে রহমত-বরকতের জন্য।
সেই প্রার্থনার উছিলায় দেশের করোনা যোদ্ধাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার সামান্যতম করুণাও যদি মেলে তাহলেই আমরা সবাই ভালো থাকবো। ভালো থাকবে স্বদেশের জীবনবাজি রাখা করোনা যোদ্ধা ও তাঁদের প্রিয়তম স্বজনরা।
এই মুর্হুতে আমি-আপনি কোন ধর্মাবলম্বী সেটার চেয়ে বড়ো পরিচয় হোক, ‘আমরা সবাই মানুষ, একই রক্তমাংসে এক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি’।
আর যাঁরা আমাদের বাঁচাতে অকালে না ফেরার দেশে চলে গেলেন এবং এখনো যাঁরা জীবনের নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও আমাদের পাশে আছেন; তাঁদের জন্য সম্মিলিতভাবে পরম দয়ালের কাছে শুভ কামনা চাইছি।
**প্রদীপ চৌধুরী: খাগড়াছড়ির সংবাদকর্মী। লেখাটি সম্পুর্ন লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত**