নিজ গ্রামে কোন স্কুল না থাকায় ছোটবেলা থেকে অন্য মানুষের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করতে হয়েছে। বাড়ির কাজের পাশাপাশি ক্ষেত খামারের কাজ জমিতে হালচাষ কখনো জুম চাষ আবার কখনো দিন মজুর সহ কঠিন কষ্ট ও পরিশ্রম করে লেখা পড়া করেছেন বরকল মডেল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাত বিন্দু চাকমা।
জীবনের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট ভোগ করলে ও পড়া লেখার হাল ছাড়েননি তিনি। নিজেকে মানুষ রুপে গড়ে তোলা আর এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানো ছিল তার লেখাপড়ার মুল উদ্দেশ্য। তিনি আজ তার স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছেন। তিনি আজ দূর্গম জনপদে এক আলোকিত মানুষ। এলাকায় যেমনি তার যশ খ্যাতি রয়েছে তেমনি তার শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে অনেক ছাত্র ছাত্রী দেশ বিদেশে উচ্চ পদে চাকরী করছেন। আবার অনেকেই জনপ্রতিনিধি প্রথাগত হেডম্যান কার্বারী আবার অনেকেই ব্যবসাসহ সমাজের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে নানামুখী কর্মকান্ড করে যাচ্ছেন। বর্তমানে শিক্ষক প্রভাত বিন্দু চাকমা পার্বত্য রাঙামাটির বরকল উপজেলার বরকল মডেল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। দুর্গম প্রত্যন্ত জনপদে তিনি একজন সফল শিক্ষক।
তার সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, তিনি ১৯৬৯ সনে ৫ই মার্চ বরকল উপজেলাধীন ৪নং ভুষণছড়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের লুদি বাঁশছড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা রাঁঙ্গা চুলা চাকমা ছিলেন একজন কৃষক। মাতা রাঙাবী চাকমা ছিলেন গৃহিনী। পিতা মাতা উভয়ে ছিলেন কর্মঠ ও ধর্ম পরায়ণ। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বড় ভাই প্রতিময় চাকমা ও ছোট ভাই সমর বিকাশ চাকমাসহ একই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
তিনি ১৯৭৩ সনে বগাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরবর্তী বছরে সুয়ারী পাতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে একটানা ৩ বছর অধ্যয়ন করেন। তৎসময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারনে সুয়ারী পাতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আগুনে পুঁড়ে গেলে ১৯৭৮ সালে পূনরায় বগাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সেই সময়ে উপজেলা সদরের আশে পাশে কোন জুনিয়র স্কুল না থাকায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৭৯ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৮৪ সনে বাবুছড়া বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় হতে মানবিক বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উর্ত্তীণ হন। এসএসসি পাশের পর ১৯৮৪ সনে রাঙামাটি সরকারী কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সনে দ্বিতিয় বিভাগে আইএ পাশ করেন।
তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই সময়ে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তার পরিবার উদ্ধাস্তু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তিনি পাননি। একদিকে আর্থিক সংকট অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারায় মানসিক ভাবে ভেঁঙ্গে পড়েছিলেন। পরে আবার ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের বাসনা নিয়ে ১৯৮৭ সনে বরকল উপজেলা সদরে জুনিয়র স্কুল চালু হলে সেখানে জুনিয়র শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। সেই সময়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি প্রতি মাসে সম্মানী পেতেন ৬শ টাকা, তাও ছিল অনিয়মিত ছিল। এর পরে ১৯৮৮ সনে বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হলে প্রতি তিন মাস অন্তর ২ হাজার ২শ ৫০ টাকা করে সম্মানী পেতেন। সেই শিক্ষকতার টাকায় ও অন্যর বাড়িতে টিউশনি করে আবারও রাঙামাটি সরকারী কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৮৯ সনে বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসাবে রাঙামাটি সরকারী কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে বিএ( স্নাতক) পাশ করেন।
১৯৯১- ৯২ শিক্ষা বর্ষে চট্টগ্রাম সরকারী টির্চাস ট্রেনিং(টিটি) কলেজ থেকে দ্বিতিয় শ্রেণীতে বিএড ডিগ্রি অর্জন করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে ১৯৯৫ সনে দ্বিতিয় শ্রেণীতে এমএ ( স্নাতকোত্তর) ডিগ্রি লাভ করেন। এর পরে ১৯৯৭ সনের ১২ জুলাই প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। ৩২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি জুনিয়র থেকে মাধ্যমিক ও মডেল বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়। এর পর ২০১৮ সনের ৯ই অক্টোবর সরকারী করণ করা হয়। বর্তমানে তিনি শিক্ষকতা পেশায় ৩২ বছর পেরিয়ে ৩৩ বছরে পর্দাপন করেছেন। তার সহ-ধর্মীনি বিশাখা চাকমা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পরিদর্শিকা পদে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। মেয়ে প্রজ্ঞা চাকমা(গুলো) ঢাকার লাল মাটিয়া মহিলা কলেজে এইচএসসিতে এ বছর ফাইনাল পরীক্ষা দেবে।
শিক্ষকতার জীবনের সুখ দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত দিন গুলোর কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, ৩২ বছর শিক্ষকতার জীবনে দুঃখের স্মৃতি তেমন না থাকলেও সুখের স্মৃতি অনেক রয়েছে বলে জানান। ১৯৮৯ সনে ডিগ্রি পাশ করার পর আর্থিক অনটন দেখা দিলে সরকারী চাকুরীর জন্য আবেদন করি এবং পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অফিস সহকারীর পদে নিয়োগ পায়। ওই চাকুরীতে যোগদান করতে যাওয়ার সময় বিদ্যালয় ও ছাত্র ছাত্রীদের মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে চাকুরীতে যোগদান না করে আবার শিক্ষকতার পেশায় ফিরে আসেন।
দুঃখের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০০৩ সালে বিদ্যালয়ে ১শ ১৬ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে মাত্র ১২ জন শিক্ষার্থী পাশ করেছিলেন। সেটি শিক্ষকতার জীবনের ব্যর্থতা ও দুঃখময় স্মৃতি। সেই স্মৃতি আজো তাকে ব্যাথিত করে। আর সুখময় স্মৃতির মধ্যে তার শিক্ষকতার ৩২ বছরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কেউ কেউ জন প্রতিনিধি,কেউ প্রথাগত মুরব্বী (হেডম্যান কার্বারী)। আবার কেউ কেউ দেশ বিদেশে উচ্চ পদে চাকুরী করছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী রয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ অফিসার ড.দীপংকর চাকমা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর আ ন ম নুরুল আফসার এডিশনাল এসপি জিনিয়া চাকমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কর্মকার রাঙামাটি সরকারী কলেজের প্রভাষক অতুল শান্তি চাকমা ৩১ তম বিসিএস এর কর কমিশনার জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা বরকল রাগীব রাবেয়া কলেজের অধ্যক্ষ নৈচিং রাখাইন ও সহকারী রাজস্ব (এনবিআর) কর্মকর্তা পপি চাকমা সহ আরো অনেকেই রয়েছেন তার শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনিষ্টিটিউটের পরিবেশ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড.শ্যামল কর্মকার বলেন, প্রভাত বিন্দু চাকমা স্যার আমার জীবনের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। আমি ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত স্যারের কাছে পড়েছি। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সময় স্যার আমাকে আলাদা করে ইংরেজী পড়াতেন। স্যারের পড়ার কৌশল ছিল অন্য স্যারদের চাইতে সম্পূর্ন আলাদা।
এছাড়াও আমি আইএ পাশ করার পর বরকল মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছু শুন্য পদে লোক নেয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয়। তখন আমি পিয়ন পদে আবেদন করে ইন্টারভিউ দিতে গেলে স্যার আমাকে পিয়ন পদে চাকরী না করতে বারন করেন। বলেন তুমি একজন ভালো ছাত্র। তুমি উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের চেষ্টা করো অনেক দুর এগিয়ে যেতে পারবে। স্যার এভাবে অনেক বুঝানোর পরে ইন্টারভিউ না দিয়ে স্যারের সেদিন কথা শুনে আমি প্রেরণা পেয়েছি। এক বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর জার্মান সরকারের বৃত্তি লাভ করে জার্মান থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনিষ্টিটিউটের পরিবেশ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন বলে জানান ড.শ্যামল কর্মকার।
রাঙামাটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাষক অতুল শান্তি চাকমা বলেন, প্রভাত বিন্দু স্যার এক দিকে দয়ালু কিন্তু পড়া লেখায় কঠোর। বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন। যারা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী তাদের আলাদা করে পড়াতেন। এতে কোন ছাত্র ছাত্রীর কাছ থেকে আলাদা পড়ানোর জন্য তিনি কোন টাকা পয়সা নেননি। তিনি সদা সত্যবাদী ও ধার্মিক। স্যার প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর থেকে বিদ্যালয়ের দিন দিন উন্নতি হয়েছে। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে বিদ্যালয়টি সরকারী করণ করা হয়েছে। স্যারের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে আমরা অন্য মানুষকে ও আলোকিত করতে পারছি।
বরকল রাগীব রাবেয়া কলেজের অধ্যক্ষ নৈচিং রাখাইন বলেন, স্যারকে আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে পেয়েছি। বিদ্যালয়টি যখন চালু হয় তখন আমি ছিলাম প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। প্রভাত বিন্দু স্যারসহ বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় এবং তাদের সুশিক্ষায় আজ আমি এ জায়গায় আসতে পেরেছি। তবে আমার দেখা প্রভাত বিন্দু স্যার এলাকার সন্তান হিসাবে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। স্কুলে নামে মাত্র চাকরী করলে ও সেই সময়ে বেতন পেতেন না।
তিনি আরো বলেন, এক বেলা ভাত জুটলেও আরেক বেলা জুটতে কষ্ট হতো। অন্যর বাড়িতে টিউশন করে পেটের ভাত জোগাতে হয়েছে। এত কষ্ট করেও শুধু মাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসার কারনে সরকারী চাকুরীতে চলে যেতে পারেননি। স্যারের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে আজ দেশ ও জাতির সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। যতোদিন বেঁচে থাকবো প্রভাত বিন্দু স্যার সহ স্কুলের আরো অন্যান্য স্যারদের আত্মত্যাগ হৃদয়ের অন্তঃ স্থলে গেঁথে রাখবো।
এই গুনী শিক্ষক প্রভাত বিন্দু চাকমা বরকল উপজেলায় শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন আলোকবাতি ঘর। তার শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে আজ বরকল উপজেলা থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী দেশ বিদেশে উচ্চ পদে চাকরী করছেন। অনেকেই জনপ্রতিনিধি প্রথাগত হেডম্যান কার্বারী আবার অনেকেই ব্যবসাসহ সমাজের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে নানামুখী কর্মকান্ড করে যাচ্ছেন। তারা দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সত্যিই প্রভাত বিন্দু চাকমা স্যার একজন মানুষ গড়ার কারিগর।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.