২০১৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭জনসহ সারাদেশে ১০ জন আদিবাসী হত্যার শিকার হয়েছে

Published: 29 Mar 2018   Thursday   

২০১৭ সালে অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭ জনসহ সারাদেশে ১০ জন আদিবাসীকে হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪১ জন আদিবাসী অধিকার কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার ও সাময়িক আটক এবং ১৬১ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন ও হামলায় ২০৩ জন আহত এবং ৭৯টি ঘরবাড়িতে তল্লাশী চালানো হয়েছে।

 

বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ওপর মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

 

গণমাধ্যমে পাঠানো কাপেং ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা সোহেল হাজং এর স্বাক্ষরিত এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, বৃহস্পতিবার ডেইলি স্টার ভবনে কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১৭ সালের বাংলাদেশের আদিবাসীদের ওপর মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন প্রকাশ ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।

 

কাপেং ফাউন্ডেশন চেয়ারপার্সন এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদ-এর সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন এর সভাপতিত্বে সম্মানিত অতিথি ছিলেন, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস-এর সদস্য উষাতন তালুকদার এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ-এর ডীন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর সদস্য অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা,  অক্সফ্যাম-এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এম বি আক্তার, এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।

 

স্বাগত বক্তব্য দেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’-এর অন্যতম সম্পাদক পল্লব চাকমা। কাপেং ফাউন্ডেশনের সদস্য সোহেল হাজং-এর সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী ভিকটিমরা অংশ গ্রহণ করেন। 

 

কাপেং ফাউন্ডেশন তার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের আদিবাসীদের সার্বিক মানবাধিকার-পরিস্থিতি ছিল খুবই উদ্বেগজনক। এ বছরটিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জনমনে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অধিকার কর্মীদেরকে চাঁদাবাজি, অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি সাজানো অভিযোগে অভিযুক্ত করে মিথ্যা মামলা দায়ের, ধরপাকড়, জেলে প্রেরণ, আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন জোরদার করেছে। নৃশংসভাবে মারধর করার ফলে গুরুতর আহত হওয়ায় পুলিশ গ্রহণ করতে অপরাগতা জানিয়েছে এমন ধরনের অন্তত তিনটি ঘটনা ঘটেছে। রমেল চাকমাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার পরও তার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে।

 

২০১৭ সালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ বা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ার চলে যায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে। যার ফলে সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১২ হাজার ১৯৫টি পরিবার-এর জীবন হুমকীতে রয়েছে যার মধ্যে অধিকাংশই এখনও উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছে। মোট ২৫০ ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৩৭ টি এবং সমতলে ১৩টি। ভূমি কেন্দ্রিক মিথ্যে মামলা হয়েছে মোট ২৮৫জন আদিবাসীর বিরুদ্ধে। গেল বছর ২ জুন রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি  অগ্নিসংযোগ এবং দোকান ভাংচুর এবং লুটপাট করা হয়েছিল। গুণমালা চাকমা নামে এক বৃদ্ধ মহিলাকে আগুণে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৭ সালের ১ জানুয়ুারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৮টি (সমতলে ২০টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৮টি)। ৪৮টি ঘটনায় মোট ৫৮ জন আদিবাসী নারী ও মেয়েশিশু যৌন বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয়। যার মধ্যে, ৯ জন আদিবাসী নারীকে হত্যা ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় যা গত ১০ বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘণের সর্বোচ্চ রেকর্ড এটি। এবং কমপক্ষে ১২ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয় এবং ৯ জন নারীকে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। অন্যান্য ঘটনার মধ্যে ৪ আদিবাসী নারী গণধর্ষণ এবং ৮ জন আদিবাসী নারী ও কিশোরীকে অপহরণ করা হয় ২০১৭ সালে। এ বছরেও আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য বাংলাদেশে কোন বিশেষ বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আদিবাসীদের জন্য নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলেও সরকার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে কার্যকর করতে পারেনি।

 

প্রতিবেদনে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম  চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করে যে তারা চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ৯টি ধারাও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। অথচ চুক্তির মূল বিষয়গুলো যথা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে প্রশাসনিক ও আইনগত পদক্ষেপ; সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ সহ ভূমি ও ভূমি ব্যাবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ এবং যোগাযোগ ব্যাবস্থার মত বিষয়গুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেদখলকৃত জমিগুলো প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া; ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী  ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের যথাযথ পুনর্বাসন করা; অপারেশন উত্তরণ সহ পার্বত্য অঞ্চল থেকে সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ও অস্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে দেয়া লীজ বাতিল করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হয় একবারেই বাস্তবায়িত হয়নি নতুবা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।

 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, দেশে এক প্রকার যে অধিকারহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলমান রয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আসা এ দেশে হতে দেয়া যাবে না। এই প্লাটফর্ম থেকেই আমাদের বিচারহীনতা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে আর সবাই বলবে আমাদের করার কিছু নেই এটা হতে দেয়া যায় না। আদিবাসী মানুষের সমস্যা শুধু তাদের সমস্যা না এটা দেশের প্রতিটা বিবেক সম্পন্ন মানুষের সমস্যা। এ সমস্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

 

ঊষাতন তালুকদার এমপি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে লাদেন গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানী প্রশাসনের সহযোগিতায় আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নিচ্ছে, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করছে। সাধারণ নাগরিক সেখানে অসহায়। সরকারও যদি সেখানে নিরুপায় হয় তাহলে সরকার কিভাবে কাজ করবে বলে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন।

 

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের বিষয়টি দেখতে হবে। তারপর আদিবাসী নারী যারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। দুইজন মারমা মেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে আবার কিছুদিন আগে আদিবাসী ২ জন নারীনেত্রী অপহরণের শিকার হয়েছে। তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানান একটি বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য, তা হলো: দেশ এখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, আমরা উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছি কিন্তু সেই উন্নয়ন যদি সমাজের অন্যান্য ঘটনার সাথে সমান তালে না চলে তাহলে আমাদের উন্নয়নশীল দেশের ধারায় চলতে গিয়ে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হবে। সুতরাং আদিবাসী নারীর প্রতি সহিসংসতা বন্ধ করতে হবে।

 

অধ্যাপক বাঞ্চিতা চাকমা বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশিরভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারাই। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা সংঘাটত কোন ঘটনার তদন্ত করা যাবে না, দেশের এমন আইন সংশোধন করতে হবে।

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত