রামগড়-সাবরুম স্থল বন্দর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার

Published: 28 Nov 2017   Tuesday   

খাগড়াছড়ির রামগড়ে দেশের ২৩তম স্থল বন্দর স্থাপনের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আর এই স্থল বন্দর স্থাপনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফেনী নদীর ওপর রামগড়-সাবরুম অংশে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ এর নির্মাণ কাজ শুরু করায় অত্রাঞ্চলের আশা জাগানিয়া মানুষগুলোর মনে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যাশা জাগছে স্বাভাবিভাবেই।

 

সমাজের খেঁটে খাওয়া মানুষ থেকে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আশা রামগড় স্থল বন্দরকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি সর্বত্র কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে, বৈদেশিক বানিজ্যে এগিয়ে যাবে দেশ, সফল কানেক্টিভিটিতে যুক্ত হবে সমৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পাহাড়ের এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। বড় কিংবা ছোট কোন ধরনেরই মিল ফ্যাক্টরি কল কারখানা না থাকায় বিপুল সংখ্যক মানুষ অত্যন্ত কায়ক্লেশে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন।

 

 খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সুদর্শন দত্ত ও অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী মনে করেন, অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে  রামগড় স্থল বন্দর অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে অবশ্যই তা একটি ইতিবাচক খবর। একটা সময় ধরেই নেওয়া হয়েছিল এটা বোধহয় আর হচ্ছে না। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আগ্রহ এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতায় সফলতার দিকে এগুচ্ছে রামগড় -সাবরুম স্থল বন্দরের অগ্রযাত্রা। পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রথম স্থাপিত এই বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞ এ সব দরিদ্র মানুষের মুক্তির নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে বলে,তাঁরা মনে করেন। এ বন্দর দুদেশের মানুষের জন্যই হবে আর্শীবাদ স্বরুপ।

 

এই বিশ্বায়নের যুগে কোন দেশ কিংবা একই দেশের সব অঞ্চল কোন বিশেষ পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না-ও হতে পারে। প্রাকৃতিক ও বৈষয়িক সুবিধা, উৎপাদনে বিশেষজ্ঞতা ও শ্রম বিভাগের কারণে উৎপাদিত পণ্য পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আদানÑপ্রদানের বিষয়টি স্বাভাবিক নিয়মেই হয়। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর তো বহু আগেই বলেছেন, “পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে-”।

 

জানা যায়, গেল ১০নভেম্বর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ভাবে ভূমি পুজার মাধ্যমে ফেনীর নদীর ওপর নির্মিয়মান বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ এর নিমার্ণ কাজ শুরু করায় নতুন আশায় উজ্জীবিত এ সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ীরা। বিশ্লেষকদের মতে, বিপুল সংখ্যক  মানব সম্পদ কাজে লাগবে অযুত সম্ভাবনার এই কর্মযজ্ঞে। ওই সময় চাকরি-বাকরি,ব্যবসা-বানিজ্যে সবার সামনেই খুলে যাবে নতুন এক স্বর্ণালী সময়,যেন বহুবছরের প্রত্যাশিত চাওয়া।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়,চট্রগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়,আসাম,মনিপুর মিজোরাম,নাগাল্যান্ড এবং অরুনাচল এই সাত রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) সঙ্গে ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারণ করতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার বহু আগেই রামগড়-সাবরুম স্থল বন্দর স্থাপনে উদ্যোগী হয়। যদিও রাজনৈতিক ও নানা আমলা তান্ত্রিক  জটিলতায় এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন থমকে ছিল। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে চলতি বছরেই বাস্তবে রুপ নিতে যাচ্ছে বহুকাঙ্খিত রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দরের দৃশ্যমান অবকাঠামো।

 

এ জন্য ভারত সরকার ফেনী নদীর ওপর চার লেন বিশিষ্ট আর্ন্তজাতিক মানের একটি সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। রামগড় পৌরসভার মহামুনি ও সাবরুমের আনন্দপাড়া এলাকা হয়ে সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য ভারত সরকারের খরচ হবে ১১০ কোটি রুপী। আর নিমার্ণ সময় ধরা হয়েছে দুইবছর পাঁচমাস। বাংলাদেশ ও ভারত সরকার ইতিমধ্যে স্থলবন্দর কে ঘিরে বন্দর টার্মিনাল, গুদামঘর সহ অন্যান্য অবকাঠামো নিমার্ণে ভূমি অধিগ্রহণ কাজও চুড়ান্ত করেছে।

 

রামগড় বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর রহমান মতি ও প্রেসক্লাবের  সাধারন সম্পাদক বেলাল হোসাইন এর ভাষ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই সচেষ্ট ছিল। এটা সম্ভব হওয়ায় ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ( সেভেন সিস্টার্স) চট্রগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ব্যবসা-বানিজ্যে গতি আনতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন দুদেশেরই ব্যবসায়ীরা। খাগড়াছড়িসহ চট্রগ্রামের ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই রামগড় স্থল বন্দরের অগ্রগতি বিষয়ে খোঁজ খবর রাখছেন, সরেজমিন পরিদর্শনও করেছেন অনেকে। রামগড় স্থল বন্দর চালু হলে ব্যবসা-বানিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটবে, পুরো এলাকার চেহারাটাই পাল্টে যাবে ।

 

রামগড় সড়ক বিভাগের প্রকৌশলী রিমন চাকমা ও জাইকার প্রতিনিধি সুদীপ্ত চাকমা জানান, রামগড় স্থল বন্দরের সঙ্গে চট্রগ্রাম বন্দরের সংযোগ সড়ক (রামগড় - বারৈয়ারহাট পর্যন্ত) উন্নয়নের কাজ বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা কর্তৃক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হওয়ায় আশা করা যায় কাঙ্খিত সময়ের মধ্যেই এটি সম্পন্ন হবে। এ সড়কটি চার লেনে রুপান্তরের কথা রয়েছে। এবং পাশাপাশি চট্রগ্রামের নাজিরহাট থেকে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনার কথা হাটহাজারিতে গত ৬ জানুয়ারী এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, স্বয়ং রেল মন্ত্রী মুজিবুল হক।

 

অন্যদিকে ত্রিপুরার আগরতলা থেকে সাবরুম পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সরেজমিন এই প্রতিবেদক গত বছর অক্টোবর মাসে সাবরুম রেল ষ্টেশনের নির্মিয়মাণ অবকাঠামো স্বচক্ষেই দেখে এসেছেন। এ ছাড়া সাবরুম-উদয়পুর-আগরতলা সড়কগুলো এ মহকুমার সঙ্গে অন্য মহকুমা ও জেলার সড়ক উন্নয়নের কাজ হাতে নিয়েছে। সড়ক পথে রামগড় - চট্রগ্রাম বন্দরের দুরুত্ব ৭২ কিলোমিটার এবং সাবরুম - আগরতলা ১৩৩ কিলোমিটার।

 

বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী  গেল ২ জানুয়ারী খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় জানিয়েছেন, রামগড় স্থলবন্দর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ২৩ তম। এ জন্য রামগড়ের মহামুনিতে ১০ একর জমি অধিগ্রহনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। প্রয়োজনে পরে আরও নেওয়া  হবে। 

 

এর আগে বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আয়োজনে ৭ ডিসেম্বর ’১৬ রামগড় পৌর মিলনায়তনে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের উপস্থিতে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা বৈঠক শেষে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্রগ্রামের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলৗ বিধান চন্দ্র ধর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন,ফেনী নদীর ওপর ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ দশমিক আট মিটার প্রস্থ সংযোগ সেতুটির নির্মাণ ভারত সরকার করবে। তবে মূল সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ১৫০ মিটার। ধারনা করা হচ্ছে ২০১৯ সাল নাগাদ কাজ সম্পন্ন হবে। ভারতের জাতীয় সড়ক বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আনন্দ কুমার ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।।

 

উল্লেখ্য,গেল ৬ জুন ’১৫ ঢাকা সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেনী নদীর ওপর রামগড়- সাবরুম মৈত্রী সেতু -১ এর  ভিত্তিপ্রস্তর উম্মোচন করেন।

 

পার্বত্য চট্রগ্রামের প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত ১৯২০ সালের সাবেক মহকুমা শহর খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায়       স্থলবন্দর স্থাপনের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ দেড় যুগের পর নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় নতুন ভাবে আলোচনায় আসে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রামগড়ে স্থলবন্দর স্থাপনের ঘোষনা দেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই স্থলপথ ও অভ্যন্তরীণ জলপথে ভারত ও মায়ানমার থেকে আমদানি-রপ্তানি বা খাদ্য ছাড়করণের উদ্দেশে দেশে ১৭৬টি শুল্ক ষ্টেশনের তালিকা ঘোষনা করে।  ওই তালিকায় ৪৮ নম্বর ক্রমিকে ছিল রামগড় স্থল শুল্কষ্টেশন। শুল্ক ও বর্ণিত পদ্বতি শর্তাবলী পালন করে পণ্যের গুনাগুন, পরিমাপ, মূল্য ও শুল্ক শ্রেণী বিন্যাস সম্পর্কিত প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা যাবে।

 

প্রসঙ্গত, সরকার ঘোষিত ১৭৬টি স্থল বন্দরের বেশকিছু ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় রামগড় স্থলবন্দর স্থাপনের কাজ দীর্ঘদিন ফাইল চাপা থাকলেও ২০১০ সালে স্থলবন্দর স্থাপনের কাজ পুনরায় শুরু হয়।

 

 বিশিষ্ট  ব্যক্তিত্ব মংপ্রু চৌধুরী ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল কাদের বলেন, দীর্ঘদিন ধীরগতিতে কাজ চললেও সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ উভয় পক্ষ ত্বরিত গতিতে স্থলবন্দর বাস্তবায়নের কাজ শুরু করায় ব্যবসায়ীসহ সকল মহল আশার আলো দেখছেন। সব মিলিয়ে রামগড় স্থল বন্দর পূর্নাঙ্গ ভাবে চালু হলে বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে যে, বিশাল ভূমিকা রাখবে নিশ্চিত ভাবেই তা বলা যায়। আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচিত হবে এক নতুন দিগন্তের। আঞ্চলিক গন্ডি ছাপিয়ে এ যেন বিশ্বব্যাপি সেতুবন্ধনের এক পূর্বাভাস।

 --হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত