গেল বছর সারা দেশে ২৩ আদিবাসী হত্যার শিকার,ন্যায়বিচার হয়নি একটিরও

Published: 26 Feb 2017   Sunday   

রোববার রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৬-এর প্রকাশ ও মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।

 

মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, গেল বছর সর্বমোট ২৩ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। যার একটিরও ন্যায় বিচার আদিবাসীরা পায়নি। এছাড়া গেল বছর ভূমি সংক্রান্ত হামলার ঘটনায় ৬ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। যার মধ্যে সমতলের ৫ জন ও পাহাড়ের ১ জন এবং ৮৪ জনকে জখম করা হয়েছে।

 

রিপোর্টে আরও বলা হয়, ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির কার্যত এখনো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।


দি ডেইলি স্টার সেন্টারের তৌফিক আজিজ খান সেমিনার হলে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান। কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেন-এর সভাপতিতে সম্মানিত অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট নারী নেত্রী ও নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির; বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কাপেং ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপার্সন চৈতালী ত্রিপুরা। ২০১৬-এর মানবাধিকার রিপোর্টের সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সম্পাদক পল্লব চাকমা।


এছাড়া মাড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে গেল বছর সারাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সরাসরি শিকার আদিবাসীরাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন গাইবান্ধা বাগদা ফার্ম থেকে আগত ডা. ফিলিমন বাস্কে, অলিভিয়া হেমব্রম, মধুপুর থেকে আগত অজয় এ মৃ প্রমুখ। এছাড়াও অনুষ্ঠানের মুক্ত আলোচনায় আরো অংশ্রগহণ করেন, মাহবাবুব হোসেন, হরেন্দ্রনাথ সিং, এন্ড্রু সলোমার প্রমুখ।


প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন, এদেশের আদিবাসীরা জনগণ থেকে অজনগণে পরিণত হচ্ছে। তাদের সংখ্যা শূন্য করা হচ্ছে। আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষা করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির কোন উন্নয়ন হবে না। একজন ব্যক্তিরও যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় তাহলে সেটি সকল জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথকে প্রশস্ত করছে।
তিনি আরো বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর চোখে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি সেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী ভেদাভেদ ছিলনা। আজকে কেন তাহলে আদিবাসীদের অন্য চোখে দেখা হচ্ছে। আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কেন রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম সেটির বাস্তবায়ন না হলে আমাদের সোনার বাংলাদেশ রচিত হবে না।


তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রেই বলা হচ্ছে সমতা, সামাজিক ন্যায়চিার, মানবসত্ত্বার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা। এবং এই তিনটির সমন্বিত রূপকেই আমরা মানবাধিকার বলছি। এখন এই মর্যদা রক্ষায় রাষ্ট্র কি তার সঠিক দায়িত্ব পালন করছে। করছে? রাষ্ট্রের দায়িত্ত্ব মানুষের মর্যাদা রক্ষা করার। কিন্তু আমরা দেখছি রাষ্ট্রের জনগণের রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে সেই পুলিশেরাই সাঁওতালদের ঘরে আগুন জ্বালাচ্ছে।


গাইবান্ধার এসপিকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হচ্ছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের উচিত যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সাথে জড়িত তার বিচার, তদন্ত শেষ না পর্যন্ত তাকে তার কর্ম থেকেও সাময়িক অব্যাহতি দেয়া উচিত এবং তদন্ত শেষ হলে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।


বিশেষ অতিথির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, আমাদের দেশের মানবাধিকার নিঃসন্দেহে ভালো যাচ্ছে না। কারণ এখানে মুক্ত চিন্তার মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষাকে রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে আমাদেরকে উত্তোরণ ঘটাতে হবে। গাইবান্ধার যে এসপি সাঁওতালদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী এবং যিনি তদন্তের আওতাধীন আছেন তাকে কিভাবে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়? সরকারকে এর উপযুক্ত যুক্তি বা কারণ জানানোর জন্য তিনি আহ্বান জানান।


তিনি আরও বলেন, ভাষার মাসে আমরা যদি শুধু বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করি এবং অন্যদিকে এদেশেরই আদিবাসীদের ভাষাকে যদি রক্ষা না করি তাহলে তা আমাদের জন্যই লজ্জাজনক হবে বলে মনে করি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যে তাৎপর্য সেটি আমরাই লঙ্ঘন করছি।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীরা সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ সময় ও পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। আদিবাসীদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আগের চাইতে কমেছে নাকি বেড়েছে তার চাইতে বড় বিষয় হলো এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার কয়টির বিচার হয়েছে? বাগদা ফার্মে যে ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে তা আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখেছি কিন্তু সরকার বা কোন দল এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের জন্য কিছুই করেনি। তবে মহামান্য উচ্চ আদালত সরকারকে বারবার প্রশ্ন করে একটি সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।

 

অক্সফামের সিনিয়র পলিসি অফিসার মেহবুবা ইয়াসমিন বলেন, আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট এদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকারের সত্যিকারের চিত্র বুঝতে আমাদের সহায়তা করছে। এ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আমরা আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতীকরণে করনীয় সহজে ঠিক করতে পারি।


সভাপতির বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, আদিবাসীরা এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে এবং ন্যায়বিচার না পেয়ে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষায় সরকার যেখানে নির্লুপ্ত সেখানে আদিবাসীদেরকেই রাজপথের সংগ্রাম করতে হবে। আদিবাসীদের মাঝেও ধর্মের নামে যে বিভাজন তৈরির চক্রান্ত চলছে সে বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে।


পল্লব চাকমা আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্টে বলেন, ক্রমাগত জমি দখলের কারণে ৩১,৬৯৯ পরিবারের জীবন ও জীবিকা হুমকির মধ্যে রয়েছে যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬০৬ টি পরিবার এবং সমতলের ৩১,০৯৩ টি পরিবার। এছাড়াও সমতলের আদিবাসীদের ১,২০৮ টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে গেল ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে বাগদা ফার্মের জমি উদ্ধারের নামে স্থানীয় প্রশাসন পুলিশের সহায়তায় এবং ভাড়াটে গুন্ডাদের মাধ্যমে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকার সাঁওতাল ও গরীব বাঙালি কৃষকদের নিজ পৈতৃক ভূমি থেকে জোর করে উচ্ছেদ চেষ্টাকালে তিনজন সাঁওতাল আদিবাসীকে হত্যা করা হয়, ১২০০ আদিবাসী পরিবারের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয় যা আদিবাসীদের অসহায়ত্ব ও নিকৃষ্টতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ।


তিনি আরো বলেন,২০১৬ সালে সারাদেশে আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি ৫৩টি ঘটনায় ৫৮ জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যার মধ্যে ৬ জন আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুকে হত্যা ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। সংগঠিত ৫৩ টি ঘটনায় ৩০ জন ভিকটিম পার্বত্য চট্টগ্রামের এবং ২৮ জন সমতলের।২০১৬ সালে অন্তত ১৯১ জন আদিবাসী মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে সমতলের ৪২ জন নিরীহ আদিবাসী গ্রামবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জন জনপ্রতিনিধিসহ ৮০ জন আদিবাসী মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সমতলের ৪ জনসহ মোট ৮১ জনকে আটক করা হয়।


মানবধিকার রিপোর্টে বলা হয়,আদিবাসী শিশু ও যুবদের অধিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিশ্র উন্নয়ন হলেও তাদের শিক্ষা অধিকার বছর জুড়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল। সরকার পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় মাতৃভাষা ভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করলেও এটি বাস্তবায়নে যথেষ্ট পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।

 

জাতীয় ও স্থানীয় উভয় পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা আদিবাসীদের প্রতি সরকারের আধিপত্যবাদী ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিফলিত করে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত