কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গাছড়ায় বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবী শহীদ পরিবারের

Published: 07 Dec 2022   Wednesday   

রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ছড়ায় বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবী করেছেন উপজেলার কয়েকজন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। ৭১ এর যুদ্ধকালীন সময় সহস্রধিক বাঙালীকে চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে পাক বাহিনী সৈন্য ও তাদের দোসররা গুলি করে হত্যা করেছিল।


এদিকে, শহীদ পরিবারের সদস্যদেও পক্ষ থেকে ওয়াগ্গাছড়া এলাকায় বধ্যভূমি চিহ্নিত করে স্মৃতি চিহ্ন নির্মাণ এবং রাইখালী এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এই দাবীর প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে ইউএনও ওয়াগগাছড়া এলাকায়ও পরিদর্শন করেছেন।


জানা গেছে, কাপ্তাই বীর মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের সদস্য ও কাপ্তাই উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রাইখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা দীপক ভট্টাচার্য, মিলন কান্তি দে ও সে সময়ের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ওয়াগ্গাছড়ার বাসিন্দা গৌরাঙ্গ মোহন বিশ্বাস ওয়াগ্গাছড়া এলাকায় বধ্যভূমি চিহ্নিত করে স্মৃতি চিহ্ন নির্মাণ এবং রাইখালী এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবী জানিয়ে গত সোমবার ইউএনও এর বরাবওে আবেদন জানান। চিঠিতে বলা হয়, গণহত্যায় শহীদ এবং আহত কিছু লোকের নাম রয়েছে। তারা হলেন, শহীদ নলিনী রঞ্জন দে, শহীদ নিকুঞ্জ বিহারী দে, শহীদ রায় মোহন ঘোষ, শহীদ পরান ভট্টাচার্য, শহীদ বিজয় ভট্টাচার্য, শহীদ রেবতি ভট্টাচার্য, শহীদ সুর্য্য চন্দ্র দে এবং শহীদ পাইসু মারমা। তারা সকলেই কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা। এছাড়া সুনীল কান্তি দে নামে রাইখালী ইউনিয়নের একব্যক্তি গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে প্রায় ৮ বছর আগে তিনি মারা যান।


প্রত্যক্ষদর্শী গৌরাঙ্গ মোহন বিশ্বাস জানান, যুদ্ধকালীন সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর। তার বাবা ক্ষিরোদ চন্দ বিশ্বাস চাকরি করতেন তৎকালীন রুহিনী মহাজনের মালিকানাধীন ওয়াগ্গা চা বাগানে। তাদের বসতবাড়ি ছিল বর্তমানে যেখানে ৪১ বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে সেখানে। যুদ্ধকালীন সময় ওয়াগ্গাছড়ায় একটি পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সেসময় পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালীদের ধরে এনে ক্যাম্পের পাশে ওয়াগ্গাছড়া খালের পাশে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে লাথি মেওে কর্ণফুলি খালে ফেলে দিত। আবার কিছু কিছু লোককে ক্যাম্পের পাশে একটা পাহাড়ের খাদে নিয়ে প্রথমে তাদেরকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে গুলি করে সেই গর্তেই পুঁতে ফেলা হতো। তিনি আরও জানান, ৭১ এর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় পাকবাহিনী এখানে ক্যাম্প করে এই গণহত্যা শুরু করে। তারা দেশ স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক বাঙালীকে এখানে হত্যা কওে তার দাবী।


সে সময়ের ওয়াগ্গাছড়া গণহত্যার অন্যতম সাক্ষী ওয়াগ্গাছড়ার বাসিন্দা ১শ` ৮ বছর বয়সী সহদেব দে। তবে অসুস্থতা এবং বয়সের ভারে স্মৃতিশক্তি লোপ পেলেও তিনি জানান, তিনি তখন ওয়াগ্গা চা বাগানে কাজ করতেন। পাক বাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙ্গালীদের ধরে এনে এই ওয়াগ্গাছড়া খালের পাশে গুলি করে হত্যা করতো।


শহীদ নলিনী রঞ্জন দে`র ছেলে রাইখালীর বাসিন্দা মিলন কান্তি দে এবং শহীদ রেবতি ভট্টাচার্যের ভাইয়ের ছেলে দীপক কুমার ভট্টাচার্য জানান, ১৯৭১ সালে রাইখালী বাজারের বেশ কিছু বাসিন্দা কাপ্তাই সড়কের মদুনাঘাট এলাকায় যুদ্ধরত তৎকালীন ইপিআর সদস্যদের বন্ধুক ও খাওয়ার রসদ যোগাতেন। পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার বাহিনী এই খবর জানতে পেরে ৭১ এর ২৯ এপ্রিল সকালে রাইখালী বাজার থেকে ৯ জনকে দঁড়ি দিয়ে বেঁধে মারতে মারতে ওয়াগ্গাছড়া পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং তাদের গুলি করে। তাদের মধ্যে ৭ জন সাথে সাথে মারা যান। তবে সুনীল কান্তি দে সেদিন সন্ধ্যায় আহত অবস্থায় পালিয়ে যান। এছাড়া গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৩ দিন পর নিকুঞ্জ বিহারী দে` কে আহত অবস্থায় সে সময়ে নৌকার ছিদ্দিক মাঝি বড়ইছড়ি ঘাট দিয়ে রাইখালীতে পার করে দেন। এ জন্য পাক বাহিনী ছিদ্দিক মাঝিকেও নির্যাতন করে বলে তারা জানান। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নিকুঞ্জ বিহারী দে`কে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।


এদিকে আবেদনের প্রেক্ষিত গত সোমবার ইউএনও মুনতাসির জাহান উপজেলার ৫ নং ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের ৪১ বিজিবি ক্যাম্পের বিপরীত রাস্তা দিয়ে প্রায় ২শ` মিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে ওয়াগ্গাছড়া খালের জায়গাটির পাশের ওয়াগ্গাছড়ায় পরিদর্শন করেছেন। এসময় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রুহুল আমিন, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নাজমুল হাসান, ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিরনজীত তংচংগ্যা, ইউপি সদস্য অমল কান্তি দে, কাপ্তাই প্রেস ক্লাব সাধারণ সম্পাদক ঝুলন দত্তসহ শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।


ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিরনজীত তংচংগ্যা এবং সাধারণ সম্পাদক ইউপি সদস্য অমল কান্তি দে` ওয়া¹াছড়া এলাকায় একটি বধ্যভূমির স্মৃতি চিহ্ন করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

 

কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান জানান, মঙ্গলবার শহীদ পরিবারের সন্তানরা ওয়াগ্গাছড়াকে বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবিতে এশটি আবেদন জানিয়েছেন। তিনি আবেদনটি পাওয়ার সাথে সাথে ওয়াগ্গাছড়া খালের জায়গাটির পাশের ওয়াগ্গা ছড়া পরিদর্শন করেছেন। তবে বিষয়টি এর আগে কেউ তাকে অবগত করেনি। তবে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী এবং গণ্যমান্য মুরুব্বীদের সাথে কথা বলে এই এলাকায় একটি স্মৃতি চিহ্ন করা যায় কিনা সে বিষয়ে তিনি চেষ্টা চালাবেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত