পাহাড়ে তিন দিনের ঐতিহ্যবাহী প্রাণের উৎসব শুরু

Published: 12 Apr 2022   Tuesday   

(‘পাড়ায় পাড়ায় বেরেবং বেক্কুন মিলিনে/ এইচ্চ্যা বিজু-বিজু-বিজু’...  চাকমা গান...পাড়ায় পাড়ায় বেড়াবো সবাই মিলে/ আজকে আমাদের বিজু-বিজু-বিজু।)


অবারিত সবুজ পাহাড়, অরণ্য, বন-বনানী ও ঝর্ণা ধারায় নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য বিমন্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রামের এগার ভাষাভাষি ১৫টি জাতিসত্বাদের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু,বিহু মঙ্গলবার থেকে তিন দিন ব্যাপী শুরু হয়েছে।পাহাড় এখন উৎসবের রঙিন হয়ে হয়ে উঠেছে। গেল দু’বছর মহামারী কারোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে উৎসবটি ছিল ম্লান। কারোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় এবারের পাহাড়ের প্রতিটি পাহাড় মহল্লায় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, নৃত্য-গীত, খাবার, পুজা-পার্বন সর্বোপরি অতিথি আপ্যায়নের মধ্যে দিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ়করণ, পারষ্পরিক সম্প্রীতি, স্বকীয়-স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যপুর্ণ জাতীয় সংস্কৃতিকে লালন করা এই উৎসবের অন্যতম দিক। এই তিন দিনের উৎসবে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরীব ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতি ও  মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন। পুরোনো বছরের সমস্ত গ্লানি মুছে  ফেলে যাতে নতুন বছরটি সুখে-শান্তি আনন্দে  কেটে যায় এই শুভ সূচনা কামনাই হল উৎসবের মূল উদ্দেশ্য।


উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দণি-পূর্বাঞ্চলে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম।  এখানে রয়েছে এগার ভাষাভাষি ১৫টি জাতিসত্বা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচংগ্যা, ম্রো, খেয়াং, চাক, খুমি, পাংখোয়া, বম,গোর্খা,লুসাই,আহমিয়া,রাখাইন,সাওতাল। বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে এই জনপদের আদিবাসী পাহাড়ীরা পালন করে আসছেন ঐতিহ্যবাহী বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসুক, বিষু। চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাইং, ত্রিপুরারা বৈসুক আর তংচংগ্যারা বিষু বলে থাকে। এই উৎসবটির উচ্চারনগতভাবে বিভিন্ন নামের পালন করলেও এর নিবেদন কিন্তু একই। তাই এ উৎসবটি আদিবাসী পাহাড়িদের শুধু আনন্দের নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, ঐক্য ও মৈত্রী বন্ধনের প্রতীকও বটে।


তিন দিন ব্যাপী উৎসবের  মঙ্গলবার প্রথম দিন ফুল বিজু। নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হবে। এই দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আদিবাসী মেয়েরা ঘরবাড়ি ও বাড়ির অঙিনা পরিস্কার ও অবাল বৃদ্ধবনিতা হতে সবাই নদীতে স্নান করে জল দেবের উদ্দেশ্য ফুল দিয়ে পূজা করে থাকেন। এছাড়া, ছোট্ ছোট্ ছেলে-মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে বনফূল সংগ্রহ করে বাড়ি দরজা সাজায় ও তরুন-তরুনীরা পাড়ায় পাহাড় বৃদ্ধদের শ্রদ্ধার সাথে স্নান করায়। এদিন পাহাড়ীরা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা ও সন্ধ্যায় বাড়ির অঙিনায় প্রদীপ প্রজ্জালন করে থাকে। বিভিন্ন সংগঠন এদিন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। উৎসবের দ্বিতীয় দিন মূল বিজু। এ দিনে বাড়িতে বাড়িতে শুধূ চলে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব ও আনন্দ করার পর্ব। বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খাবার দাবার আগত অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। উৎসবের শেষ দিন গজ্যাপজ্যা বিজু। এ দিনে পাহাড়ীরা সারাদিন ঘরে বসে  পূর্ন  বিশ্রাম নিয়ে থাকেন। এ দিন বৌদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে যতœসহকারে ভাত খাওয়ানোসহ আর্শীবাদ নিয়ে থাকেন। এদিনটিকে আদিবাসীরা মনে করে থাকেন সারাদিন আনন্দ আর হাসি-খূশিতে কাটাতে পারলে সারাটা বছর অত্যন্ত সূখে শান্তিতে ও ধন-ধৌলতে কেটে যাবে।


এদিকে এ উৎসবকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাড়ায়-মহল্লায় উৎসবের আমেজ বইছে। রাঙামাটিতে বিজু-সাংগ্রাইং-বৈসুক-বিষু-বিহু-সাংক্রান উদযাপন কমিটি গত রোববার বর্নাঢ্য র‌্যালী করেছে। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী বলি খেলাসহ নানান খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান  ছাড়াও নদীতে ভাসানোর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়া আগামী ১৫ এপ্রিল কাপ্তাইয়ের চিৎমরমে এবং আগামী ১৬ এপ্রিল মারমা সাংস্কৃতিক সংসদ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়াতে ঐতিহ্যবাহী জল উৎসব বা পানি খেলার আয়োজন করেছে। এই মৈত্রী পানি খেলা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এই জল উৎসব করে থাকেন। এটি মারমাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠান হওয়ায় পালন করা হয় জাঁকজমকভাবে। মৈত্রী পানি বর্ষণের মাধ্যমে পুরাতন বছরের সকল দুঃখ, গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এ জল উৎসবে সমবেত হয় পাহাড়ের মারমা সম্প্রদায়ের মানুষ।


অপরদিকে, ফুল বিজু উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে রাঙামাটিতে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিহু, বিষু ও সাংক্রান উৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে রাজন বন বিহার ঘাটে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানো হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এতে উপস্থিত ছিলেন কমিটির আহŸায়ক প্রতিকৃতি রঞ্জন চাকমা, সদস্য সচিব ইন্টুমনি তালুকদার। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে নদীতে ফুল ভাসানো হয়েছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.


উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত